ছন্দে ছন্দে সমাস শিখার কৌশল!

সমাস

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অর্থসম্বন্ধযুক্ত একাধিক পদের একটি পদে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে সমাস বলে। বাংলা ভাষায় যে সকল প্রক্রিয়ায় নতুন পদ বা শব্দ তৈরি হয় সমাস তার একটি। সমাসের রীতি সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসেছে।

জোড় বদ্ধ ছন্দ

তার নাম দন্ধ ।

পূর্বপদে সংখ্যা পরপদে সমাহার ,

দ্বিগু সমাস নাম তার ।

পূর্বপদে বিভক্তি লুপ্ত হয় ,

তৎপুরুষেই পরিচয় ।

ব্যাস বাক্যে যে- সে, যিনি – তিনি

কর্ম ধারয় তারে চিনি ।

পর্বপদে উপসর্গের প্রভাব

নাম তার অব্যয়ীভাব ।

তৃতীয় পদ প্রধান যার ,

বহুব্রীহি নাম তার ।

যেমন: দোয়াত ও কলম = দোয়াতকলম, পীত অম্বর যার = পীতাম্বর (শ্রীকৃষ্ণ)। সমাসের প্রক্রিয়ায় সমাসবদ্ধ বা সমাসনিষ্পন্ন পদটিকে বলে সমস্ত পদ। যেমন: এখানে দোয়াতকলম, পীতাম্বর হলো সমস্ত পদ। সমস্ত পদ কতগুলো পদের মিলিত রুপ, এই প্রতিটি পদকে বলে সমস্যমান পদ। সমস্ত পদকে বিস্তৃত করে যে বাক্যাংশ পাওয়া যায় তাকে বলে সমাসবাক্য, ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য। সমাস শব্দের ব্যুৎপত্তি হলো সম+অস(ধাতু) +অ ।

সমাসের উদ্দেশ্য অল্পকথায় অধিক ভাব প্রকাশ করা ।একটা বিরাট শব্দগুচ্ছকে সমাসের মাধ্যমে সংক্ষেপণ করা যায়। তবে সাহিত্যিক প্রয়োজনেই সংস্কৃত ভাষায় সমাসের আবির্ভাব হয়েছিল বলে মনে হয়। কারণ সাহিত্যমূলক কর্মে সমাসের ব্যবহার একে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

সমাস শব্দের অর্থ সংক্ষেপ,সমর্থন,সংগ্রহ, মিলন,একাধিক পদের একপদীকরণ ।

সন্ধিতে মিলন ঘটে সন্নিহিত বর্ণের, সমাসে মিলন ঘটে পাশাপাশি থাকা একাধিক পদের।যেমন: সংখ্যা+অতীত= সংখ্যাতীত (সন্ধি সাধিত); সংখ্যাকে অতীত= সংখ্যাতীত (সমাস সাধিত)। এভাবে একই শব্দ বা পদকে সন্ধিতে আবার সমাসেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সমাসে পদের ক্রম অক্ষুণ্ন নাও থাকতে পারে যেমন:পথের রাজা=রাজপথ সন্ধিতে পদের ক্রম সর্বদা অক্ষুণ্ন থাকে যেমন:বিদ্যা+আলয়=বিদ্যালয়

সমাস প্রধানত ছয় প্রকার। যথা:

  • দ্বন্দ্ব সমাস
  • বহুব্রীহি সমাস
  • কর্মধারয় সমাস
  • তৎপুরুষ সমাস
  • দ্বিগু সমাস এবং

অব্যয়ীভাব সমাস(বর্তমানে এই সমাস কে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলা হয়) ।    তবে দ্বিগু সমাসকে অনেক ব্যাকরণবিদ কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আবার কেউ কেউ কর্মধারয়কে তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ হিসেবে সমাস মূলত চারটি। যথা: দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব সমাস(বর্তমানে এই সমাস কে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলা হয়)।

এছাড়া আরও কিছু অপ্রধান সমাস আছে, যেমন: প্রাদি, নিত্য, অলুক, উপপদ ইত্যাদি।

  • যে সমাসে প্রতিটি সমস্যমান পদের অর্থের সমান প্রাধান্য থাকে এবং ব্যাসবাক্যে একটি সংযোজক অব্যয় (কখনো বিয়োজক) দ্বারা যুক্ত থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে।

দ্বন্দ্ব সমাস নয় প্রকার: 
১। সমার্থক দ্বন্দ্ব: কাজ ও কর্ম= কাজ-কর্ম, হাট-বাজার, ঘর-দুয়ার, কল-কারখানা, খাতা-পত্র
২। বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব: দিন ও রাত= দিন-রাত, জমা-খরচ, ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো, লাভ-লোকসান
৩। বিকল্পর্থক দ্বন্দ্ব: হার অথবা জিৎ= হার-জিৎ
৪। সমাহার দ্বন্দ্ব: দুধ ও কলা= দুধ-কলা,
৫। মিলনার্থক দ্বন্দ্ব: চাল ও ডাল= চাল-ডাল, মা-বাপ, মাসি-পিসি, জ্বিন-পরি, চা-বিস্কুট
৬। অলুক দ্বন্দ্ব: কাগজে ও কলমে= কাগজে-কলমে
৭। বহুপদী দ্বন্দ্ব: রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ= রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ
৮। একশেষ দ্বন্দ্ব: তুমি, আমি ও সে= আমরা

৯। অনুকার দ্বন্দ্ব: কাজ ও টাজ= কাজটাজ

  • যে সমাসের পূর্বপদ ও পরপদ কারো অর্থ প্রাধান্য পায় না ,সমস্ত পদের অর্থ প্রাধান্য্য পায়, তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।

প্রধানত বহুব্রীহি সমাস সাত প্রকার:

১/ সমানাধিকরন বহুব্রীহি: দশানন—দশ আনন যার

২/ ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি: পাপমতি– পাপে মতি যার

৩/ মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি: বিড়ালোক্ষী– বিড়ালের অক্ষির মতো অক্ষি যার

৪/ অলুক বহুব্রীহি: মুখেভাত– মুখে ভাত দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে।

৫/ ব্যাতিহার বহুব্রীহি: লাঠালাঠি– লাঠিতে লাঠিতে যে লড়াই।

৬/ না বহুব্রীহি: নির্বাক– নেই(ন) বাক যার।

৭/সহার্থক বহুব্রীহি: সবাক– বাকের সহিত বর্তমান

  • বিশেষ্যের সাথে বিশেষণের সমাসকে কর্মধারয় সমাস বলে। যথাঃ নীল যে উৎপল = নীলোৎপল। কর্মধারয় সমাসে উত্তর পদের অর্থ প্রধান হয়।

কর্মধারয় সমাস প্রধানত পাঁচ প্রকার। যথাঃ-

(১) সাধারণ কর্মধারয়

বিশেষণ ও বিশেষ‍্য, বিশেষ‍্য ও বিশেষ‍্য অথবা বিশেষণ ও বিশেষণ পদের মধ‍্যে এই সমাস হয়ে থাকে। যেমন, নীল যে আকাশ=নীলাকাশ।

(২) মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস

কর্মধারয় সমাসে কোন কোন স্থানে মধ্যপদের লোপ হয়। সেজন্যেই একে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে। যথা: হিমালয় নামক পর্বত = হিমালয়পর্বত। এখানে ‘নামক’ মধ্যপদের লোপ হয়েছে।

(৩)উপমিত কর্মধারয় সমাস

সমান ধর্মবাচক পদের প্রয়োগ না থাকলে উপমেয় ও উপমান পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: মুখ চন্দ্রসদৃশ = মুখচন্দ্র।

(৪)রূপক কর্মধারয় সমাস

উপমেয় পদে উপমানের আরোপ করে যে সমাস হয়, তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এতে উপমেয় পদে রূপ শব্দের যোগ থাকে। যেমন: বিদ্যারূপ ধন = বিদ্যাধন। এখানে ‘রূপ’ শব্দের যোগ রয়েছে।

(৫)উপমান কর্মধারয় সমাস
  • উপমানবাচক পদের সাথে সমান ধর্মবাচক পদের মিলনে যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: শশের (খরগোশের) ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত।
  • দ্বিতীয়াদি বিভক্তান্ত পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। এতে উত্তরপদের অর্থ প্রাধান্য থাকে। যেমনঃ লবণ দ্বারা যুক্ত= লবণাক্ত।

“‘তৎপুরুষ”‘ শব্দটির অর্থ হল “তার পুরুষ”। তার পুরুষ এই শব্দ গুলির একপদীকরণে তৎপুরুষ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পূর্ব পদ থেকে সম্বন্ধ পদের বিভক্তি ‘র’ লোপ পেয়েছে ও উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। এইভাবে এই সমাসের অধিকাংশ উদাহরণে পূর্ব পদের বিভক্তি লোপ পায় ও উত্তর পদের অর্থ প্রাধান্য থাকে এবং তৎপুরুষ শব্দটি হল এই রীতিতে নিষ্পন্ন সমাষের একটি বিশিষ্ট উদাহরণ।তাই উদাহরণের নামেই এর সাধারণ নামকরণ করা হয়েছে তৎপুরুষ সমাস।

তৎপুরুষ সমাস ছয় প্রকার। যথাঃ-

(১)দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ

দ্বিতীয়া-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে দ্বিতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ স্বর্গকে গত = স্বর্গগত।

(২)তৃতীয়া-তৎপুরুষ

তৃতীয়া-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে তৃতীয়া-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ রজ্জু দ্বারা বন্ধ = রজ্জুবন্ধ।

(৩)চতুর্থী-তৎপুরুষ

চতুর্থী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে চতুর্থী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ যজ্ঞের নিমিত্ত ভূমি = যজ্ঞভূমি।

(৪)পঞ্চমী-তৎপুরুষ

পঞ্চমী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে পঞ্চমী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ মুখ হইতে ভ্রষ্ট = মুখভ্রষ্ট।

(৫)ষষ্ঠী-তৎপুরুষ

ষষ্ঠী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে ষষ্ঠী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ দীনের বন্ধু = দীনবন্ধু।

(৬)সপ্তমী-তৎপুরুষ

সপ্তমী-বিভক্ত্যন্ত পদ পূর্বে থেকে সমাস হলে, তাকে সপ্তমী-তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ দিবাতে নিদ্রা = দিবানিদ্রা।

(৭)উপসর্গ-তৎপুরুষ সমাস (=অব্যয়ীভাব)
  • অনুবাদ অব্যয় পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয় এবং যাতে পূর্ব পদের অর্থেরই প্রাধান্য থাকে, তাকে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বা অব্যয়ীভাব সমাস বলে। যেমনঃ আত্মাকে অধি (অধিকার করিয়া) = অধ্যাত্ম।
(৮)উপপদ-তৎপুরুষ সমাস
  • যে পদের পরবর্তী ক্রিয়ামূলের সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয়, সে পদকে উপপদ বলে। কৃদন্ত পদের সাথে উপপদের যে সমাস হয়, তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: জলে চরে যা= জলচর, জল দেয় যা= জলদ, পঙ্কে জন্মে যা= পঙ্কজ ইত্যাদি।

এছাড়াও, নঞ্ অব্যয় পূর্বে থেকে যে সমাস হয়, তাকে নঞ্তৎপুরুষ বলে। যেমনঃ ন উক্ত = অনুক্ত।

সমাহার বা সমষ্টি বা মিলন অর্থে সংখ্যাবাচক শব্দের সঙ্গে বিশেষ্য পদের যে সমাস হয়, তাকে দ্বিগু সমাস বলে।

  • তদ্ধিতার্থে; যথাঃ পঞ্চ (পাঁচটি) গো দ্বারা ক্রীত = পঞ্চগু।
  • উত্তরপদ পরে, যথাঃ পঞ্চ হস্ত প্রমাণ ইহার = পঞ্চহস্তপ্রমাণ। (এখানে প্রমাণ শব্দ উত্তরপদ পরে থাকায় পঞ্চ ও হস্ত এই দুই পদের দ্বিগু সমাস হয়েছে)।
  • সমাহারে; যথাঃ ত্রি (তিন) লোকের সমাহার = ত্রিলোক।

দ্বিগু শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘দুটি গরু’ কিন্তু ব্যাকরণ সম্মত অর্থ হল ‘দুটি গরুর মূল্যে কেনা।

  • অনুবাদ অব্যয় পদ পূর্বে থেকে যে সমাস হয় এবং যাতে পূর্ব পদের অর্থেরই প্রাধান্য থাকে, তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। এই সমাসকে বর্তমানে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমনঃ আত্মাকে অধি (অধিকার করিয়া) = অধ্যাত্ম।

আরো বিভিন্ন পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন প্রতিদিন এবং সাথেই থাকুন।

আমাদের মডেল টেস্ট প্রোগ্রামে অংশ নিনঃ

 Model: