শীতের একটি সকাল

আজ পৌষের ষোল তারিখ । জানুয়ারির এই সময়টায় খুব শীত পড়ে।পৌষমাসের শীতে ঠক্ঠক্ করে কাঁপার কথা।কিন্তু আমার গায়ে পাতলা একটা জামা ।তেমন শীত লাগছে না ।কারণ,আমি শহরের একটি আবাসিক এলাকায় বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে।গ্রামের মতো শীত এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি ।শহরের বড় বড় দালানকোঠা,পাকা সড়ক,গাড়িঘোড়া,বিদ্যুতের বাতি আর কলকারখানার ভিড়ে শীতের প্রকোপ তেমন বোঝা যায় না।‘পৌষের শীত তুষের গায়/ মাঘের শীতে বাঘ পালায় ’ –এ প্রবাদের শীত এখানে নেই।সোয়েটার ,জ্যাকেট, কোট- টাইয়ের ভিড়ে এখানে শীত যেন ম্রিয়মাণ।শীত–সকালের আমেজ এখানে নতুন শাকসবজি আর হালফ্যাশানের গরম কাপড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ।

গত শীতে আমি নানার বাড়ি দেবরামপুর গিয়েছিলাম । বাস, রিকশা তারপর হঁটাপথে যেতে যেতে বিকেলে নানার বাড়ি পৌছলাম । পরদিন ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে মামা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন । লেপের ভেতর থেকে চোখ ডলতে ডলতে উঠে দেখি , চাদর গায়ে দেওয়া মামা আমাকে ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছেন । মামা বললেন,‘ চল্ মন্টু , গাছ থেকে খেজুর – রস নামাব । ’ আমি মহানন্দে লাফিয়ে উঠলাম ।

উঠোনে নামতেই দেখি , নানিজান মাটির চুলায় ভাপা পিঠা বানাচ্ছেন । চারদিকে খেজুর  – রসের মৌ মৌ গন্ধ । আমার জিভে প্রায় পানিন এসে গেল । মামার সাথে সাথে বাড়ির বাইরের দিকে গেলাম । কুয়াশার চাদরে ঢেকে আসবে সব । পুকুরের হিমশীতল জলে মুখ ধুলাম । তারপর গেলাম মামার সাথে খেজুর –রস নামাতে  ।

বাড়ির সীমানা ঘেঁষে বেশ কয়েকটা খেজুর গাছ । তাতে এ সময় প্রচুর রস হয় । মামা খুব সাবধানে কোমরে বাঁধা টোকাতে ঝুলিয়ে রসভর্তি মাটির কলসিগুলো একে একে নামালেন । ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে রসগুলো ঢাললেন একটা বড় গামলায় । গ্লাসে ভরে আমাকে দিলেন একগ্লাস কাঁচা রস । দাঁত অবশ হয়ে যাওয়ার মতো শীতল , কিন্তু অপূর্ব স্বাদ। খেজুর রস খেয়ে আমার শীত যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল । আমি ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলাম। মামা আমার অবস্থা দেখে হেসে উঠলেন । গ্রামের পথ- ঘাট কুয়াশার চাদরে ঢাকা । আলপথে কৃষক লাঙল কাঁধে গরু নিয়ে যাচ্ছে হাল চাষে । কুয়াশার মধ্যে তাঁদের আবছা ছায়ামূর্তি দেখা যায় । যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক সুন্দর মনোরম ছবি ।

পূর্বদিকে আবির ছড়িয়ে সূয উঠছে ডিমের কুসুমের মতো । সবুজ ঘাসে ছড়ানো শিশিরগুলোকে মুক্তোর মতো লাগছে । খালিপায়ে শিশিরসিক্ত সবুজ ঘাসে হাঁটতে গিয়ে আমার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ভেজে গেল । কিন্তু হীমশীতল শিশির স্পর্শ করতে পেয়ে আমার মন আনন্দে নেচে উঠল ।

বাড়ি ফেরার সময় দেখলাম পুকুরের পানি থেকে ধোঁয়া উঠছে । উঠোনের একপাশে তখন রোদ এসেছে । সেখানে পাঠি বিছিয়ে নানিজান ভাপা পিঠা আর কাঁচা রসের পায়েস খেতে দিলেন । অপূর্ব তার স্বাদ। শতি সকালের এমন সুখকর অনূভুতি আমি আর কখনো পাইনি । আবহমান বাংলার সংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত এই গ্রামীণ জীবনের শতের সকাল উপভোগ করে আমি ধন্য ।

শহরের বাসায় ডায়নিং টেবিলে বসে ডিম মামলেট, রুটির টোস্ট কিংবা পরোটা–ভাজির নাশতার সেই স্বাদ কোথায় ? আমাদের আবাসিক এলাকার বসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে আমি আনমনা হয়ে যাই । বাইরে তখন প্রাণের সাড়া পড়েছে । ছোট্ট ছেলেমেয়েরা স্কুলড্রেস পরে , পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে । শহরের শতের সকালের মধ্যে সেই প্রাণস্পন্দন কোথায় ? আমার বুক থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল । মনে হলো , আজকের এই শতের সকাল যদি আমার নানিবাড়িতে থাকতে পারতাম ।